ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

আমার দেখা: ভয়াল ২৯ এপ্রিল’ ৯১

মো হারুনর রশিদ ::

ছিলাম সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ক’দিন থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ছিল। আবহাওয়ার খবরাখবর জানতে একমাত্র মাধ্যম রেডিও। এলাকায় টেলিভিশন ছিল দূর্লভ বস্তু। রেডিও’র বিবিসি’র খবরই ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে সময় সিগন্যালের সতর্কবাণী দেখালেও তেমন গায়ে লাগতো না কারও। কেউ কোনদিন মনে করতো না এমন একদিন এসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিবে। ১৯৮৯ সালে পূর্ব উজানটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেণি পাশ করে ১৯৯০ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই পশ্চিম উজানটিয়া জুনিয়র হাইস্কুলে। অতঃপর নিজ বাড়ী থেকে বেশী দূরত্ব হওয়ার দরুন মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৯১ সালে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হই বদরখালী কলোনীজেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২৯ এপ্রিল’৯১ সকালবেলায় বাড়ী থেকে বদরখালী চলে আসার কথা। পিতা ও ভাইদের মুদির দোকানের ব্যবসা ছিল। সকালবেলায় দোকানেই সবাই সময় দিতেন। যার কারণে সকালবেলায় সবাই ছিল ব্যবসায়রত। কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরে পিতার নিকট থেকে দোয়া গ্রহণ করার জন্য দোকানের উদ্দেশ্যে যাত্রা। পিতাকে সালাম করে ও বড় ভাইদের সাথে কুশল বিনিময়ের পর বাড়ীতে এসে মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিতে মা বলল, আজকে ঝড়-বৃষ্টি খুব বেশী, তাছাড়া সিগন্যাল দিছে আজকে না গেলে কেমন হয়। মায়ের সাথে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক, সন্তানের বিপদের কথা মায়ের জানা হয়ে যায়। আমিও এই ভেবে আর বের হলাম না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে মাগরিবের পর পর বাতাসের তীব্রতা বেড়ে গেল। রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মীরা হ্যান্ডমাইক দিয়ে সতর্কবার্তা এলাকায় প্রচার করছে। মা বিশেষ রান্না বান্নার কাজ সেরে প্রতিদিনের চাইতে একটু আগেই খেয়ে নিলাম। দোকান থেকে পিতা আসে নাই। ধান ভাঙার মেশিন (কল) ঘরে থাকতেন আমার বড় ভাই জকির। প্রচন্ড বাতাসের তোড়ে মেশিন ঘরটি ভেঙে পড়ে যায়। শুরু হল কান্নার রোল বড় ভাই আনোয়ার ও সেজ ভাই শফিক সহ গিয়ে কোন মতে ঘরের ছালা থেকে জকির ভাইকে উদ্ধার করলেন। গোয়াল ভরা গরু ও ছাগলের পাল ছিল। সে বছর ১০টি মা গরু বাচ্চা দিয়েছিল। বড় ভাইরা গরুগুলোর বাঁধন খুলে দিলেন। বড় গরুটা ছিল শান্তশিষ্ঠ (বিরিশ)। কাছারী ঘরে (মেহমানঘর) নিয়ে আসা হল। পাড়ার মধ্যে আমাদের বাড়ীটাই ছিল বড়। বড় বড় গাছ দিয়ে ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে (সংগ্রামের বছর বলতো) দাদার বাড়ী থেকে আমার পিতা আলাদা হয়ে বর্তমান এই বাড়ীটিতে সংসার জীবন শুরু করে। পরিবারের সবাই মূল ঘরে বসে পড়লাম। বাতাসের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকল। উঠানে টর্চলাইটের আলো পড়তেই দেখা গেল বড় একটা রুই মাছ। বালতি নিয়ে বড় ভাই মাছটি ধরলেন। কিন্তু বিধিবাম ৩০ মিনিটের ব্যবধানে উঠানে কোমর পর্যন্ত পানি হয়ে গেল। সবাই মূল ঘর থেকে কাছারী ঘরে (মেহমানঘরে) এসে পড়লাম, সাথে বিরিশ গরুটাও আছে। প্রতিবেশী কয়েকটা পরিবার আমাদের সাথে যোগ দিল। পানি বাড়তেই থাকল। ওয়াপদার বেঁধিবাধ সংলগ্ন আমার পৈত্রিক বাড়ী। প্রতি বছর কয়েক দ্রোন জমিনে ফসল ফলানো হতো। খড়ের বড় স্তুপ ছিল। ঘরের ভিতর যখন পানি বাড়তেই থাকল তখন উপায় না দেখে সবাই ওয়াপদার বেড়িবাঁধে চলে আসলাম। ষাঁটটা লাফ দিয়ে আমাদের সাথে চলে আসল। আমরা সবাই বড় চিবাগাছের সংলগ্ন খড়ের স্তুপে কোনমতে আশ্রয় গ্রহণ করলাম। সারা রাত প্রচন্ড বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়ে ছিলাম। আল্লাহ আল্লাহ জপতে জপতে পূর্বদিকে দিনের আভা হাতছানি দিচ্ছে। ভোর হতেই দেখতে পেলাম আমাদের পাশের জমিতে লাশ আর লাশ। দোকান থেকে পিতা না আসাতে সবাই খুবই চিন্তিত ছিলাম। বড় ভাইরা অনেক লাশ উল্টাইয়া চেহারা দেখতাছে পিতার লাশ কিনা। অসংখ্য-অগণিত লাশ দেখেছি। বাড়ীর পাশের খালি জমিতে গর্ত খুঁড়ে একসাথে ১০/২০টি পর্যন্ত লাশকে কবর দিয়েছি। ঐ পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এখনো লাশের কথা মনে পড়ে। চতুর্দিকে দেখতে পেলাম সব এলোমেলো গাছগাছালী লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মানুষের কান্নার হাহাকার একি দৃশ্য! ভোলার নয়। উপকূলে বসবাসকারী লোকজনের আজকের ২৯ এপ্রিল দিনটি খুবই বেদনাদায়ক। অনেক পরিবার এই দিনের স্মরণে ও অসংখ্য নর-নারীর মাগফেরাত কামনায় মিলাদ-মাহফিল, কোরআনখানির ও বিশেষ জিকিরের আয়োজন করে থাকে।

পাঠকের মতামত: